ডিজিটাল বাংলাদেশ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি - তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং আমাদের বাংলাদেশ | | NCTB BOOK
13

বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ২০২১ সালে তার অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হবে এবং সে কারণে এই সময়ের ভেতরে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি বিশেষ জায়গায় নেওয়ার একটি স্বপ্ন আমাদের সবাইকে স্পর্শ করেছিল। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি শুধু একটি কথা হয়ে থাকেনি। এটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যে এই দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ সবাই একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে।প্রথমেই আমাদের জানা দরকার এনালগ ও ডিজিটাল কথাটিঅনুভূত হয়। এই অনুভূত তাপমাত্রাকে যখন সংকেতরূপে এনালগ সংকেতের সাহায্যে আমরা নির্ভুল এবং সূক্ষ্ম তথ্য দিয়ে আমরা কী বোঝাই। পরিবর্তনশীল (বিচ্ছিন্ন) ডাটাকে যখন সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে এনালগ সংকেত বলে। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দৈনন্দিন তাপমাত্রার কথা ধরা যাক, দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তাপমাত্রা প্রকাশ করি তখন তাকে এনালগ সংকেত বলি । পাই না, প্রাপ্ত মানের তারতম্য থাকে। এই এনালগ সংকেতকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দুইটি অবস্থার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, এই অবস্থাগুলোকে অঙ্কের (Digit) মাধ্যমে প্রকাশ করার ফলে এনালগ সংকেতের তুলনায় আরও নির্ভুল এবং সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর তথ্য পাওয়া যায়। Digit এর মাধ্যমে সংকেত প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত এই ধরনের সংকেতকে ডিজিটাল সংকেত বলা হয়। যেমন: ধর, কাঁটাযুক্ত ঘড়ি এনালগ সংকেত প্রদর্শন করে, পক্ষান্তরে কাঁটাবিহীন ঘড়ি ডিজিটাল সংকেত প্রদর্শন করে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি শুধু একটি 'কম্পিউটার প্রস্তুত দেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি। এটি আরও অনেক ব্যাপক। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আসলে তথ্য ও যোগাযাগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা আধুনিক বাংলাদেশ বোঝানো হয়। সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য মোচনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে আমাদের পুরাতন মানসিকতার পরিবর্তন করে ইতিবাচক বাস্তবতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা করা খুব জরুরি। ডিজিটাল বাংলাদেশের পেছনের মূল কথাটি হচ্ছে দেশের মানুষের জন্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং সুবিচার নিশ্চিত করা এবং সেগুলোর জন্যে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সকল শ্রেণির সব ধরনের মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের বাস্তবায়নের জন্যে সরকার চারটি সুনির্দিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে; সেগুলো হচ্ছে— মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনগণের সম্পৃক্ততা, সিভিল সার্ভিস এবং দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার।


পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কাজটি শুরু করেছে দেরিতে। তাই অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। অতীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি না করলেও বর্তমানে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হওয়ায় আমাদের দেশে এখন দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান সম্ব হচ্ছে।
প্রযুক্তি প্রসারের একটি সুন্দর দিক রয়েছে, কোনো দেশ বা জাতির একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকলে সব সময়েই তাদের পিছিয়ে থাকতে হয় না। বড় বড় লাফ দিয়ে (Leap Frog) অন্যদের ধরে ফেলা যায়। তাই বাংলাদেশ তার সর্বশক্তি দিয়ে সামনে এগিয়ে অন্য দেশের সমান হবার চেষ্টা করছে।
সরকারের আগ্রহের কারণে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সারা দেশে ফাইবার অপটিক লাইন বসিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাত্র এক-দেড় দশক আগেও এদেশে টেলিফোনের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় এই দেশের প্রত্যেকটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতের নাগালে ফোন রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার খোলা হয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকায় পোস্ট অফিসগুলোকে ই-সেন্টারে রূপান্তরিত করে মোবাইল মানি অর্ডারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন ইনফরমেশন সেন্টারের সাথে সাথে ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সেল এবং ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেল দেশের অবকাঠামোতে একটা বড় সংযোজন। মোবাইল টেলিফোন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানা কিংবা ট্রেনের টিকেট কেনার মতো কাজগুলো নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পাঠ সংযোজন করা হয়েছে— এই বইটি তার প্রমাণ । দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানো হচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরা কোম্পানি গড়ে তুলছে এবং বিশাল সংখ্যক তরুণ-তরুণী ব্যক্তিগত পর্যায়ে আউটসোর্সিং করে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করছে।
২০১৮ সালের ১২ই মে তারিখটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এদিনে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম রাষ্ট্র হিসেবে তার নিজস্ব স্যাটেলাইট 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে প্রেরণ করে। এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। স্যাটেলাইটটি ব্যবহার করে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, আবহাওয়ার পূর্বভাস নানা ক্ষেত্রে সুফল পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করবে। টেলিভিশন সেবা ও জাতীয় নিরাপত্তার কাজেও এ স্যাটেলাইটটি ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কারণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও সম্ভব হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই সাফল্য শুনে কেউ যেন মনে না করে আমরা ইতোমধ্যে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি— এটি মোটেও সত্যি নয়। এই পথে আমাদের আরো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে থাকে তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হচ্ছে এই গ্রামীণ মানুষকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবার আওতায় নিয়ে আসা। সেজন্য এখনো বিশাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির পুরো সুবিধা পেতে হলে এক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান বাড়াতে হবে, আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে সকল কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে উৎসাহী করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিল্পের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।

দলগত কাজ

        ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে করণীয় নিয়ে একটি পোস্টার ডিজাইন কর।

 

 

 

 

Content updated By
Promotion